পান্তা ভাত তৈরি পদ্ধতি - পান্তা ভাতের উপকারিতা

বহুকাল ধরে আমাদের দেশের গ্রাম বাংলায় পান্তা ভাতের প্রচলন চলে আসছে। যদিও গ্রাম্য জীবন ধারনের পান্তা ভাতের কদর থাকলে শহুরে জীবন যাপনের ক্ষেত্রে পান্তা ভাতের গুরুত্ব তেমন দেখা যায়না। তারা পান্তা ভাতের পরিবর্তে জ্যাম, পাউরুটি সহ অন্যান্য খাবারের গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কেউ যদি এই সামান্য পান্তা ভাতের গুরুত্ব ও এর উপকারিতা জানে তাহলে অন্য কিছু খাওয়া ছেড়ে দিয়ে পান্তা ভাতে আসক্ত হয়ে পড়বে নিশ্চিত।
 
পান্তা ভাত তৈরি পদ্ধতি - পান্তা ভাতের উপকারিতা

বাঙ্গালিদের জীবন যাত্রায় পান্তাভাত ওতপথভাবে জড়িয়ে আছে। বাঙ্গালি নববর্ষে পান্তা ইলিশের কথা শুনেনি বা খায়না এমন মানুষ পাওয়া যায়না। সাধ্য ভেদে ইলিশ খেতে না পারলেও পান্তা, মচির ও পেয়াজ খায়না এমন কম মানুষই পাওয়া যায়। পান্তা ভাতে সাধারন ভাতের তুলনায় বহু গুন পুষ্টি উপাদান রয়েছে। এক গবেষনায় দেখা গেছে সাধারন ভাতের তুলনায় পান্তা ভাতে পুষ্টি উপাদান ২১ গুন বৃদ্ধি পায়।

ভূমিকা

বর্তমান আধুনিক পৃথিবীতে আমাদের দেশের এখনো গ্রামের অনেক বাড়িতে পান্তা ভাত সকালের খাবার হিসাবে খাওয়া হয়ে থাকে। শহুরে জীবনে পান্তা ভাতের স্থান নেই বললেই চলে। পান্তা ভাত তৈরি হয় সাধারণত খাবারের পর যে অবশিষ্ট ভাত থাকে সেই ভাতকে নষ্টের হাত থেকে রক্ষা করতে পানিতে ভিজিয়ে রেখে তৈরি করা হয় পান্তা ভাত।
 
আরো পড়ুন: কাঁচা পেঁপে খাওয়ার উপকারিতা

পান্তা ভাত তৈরি পদ্ধতি

রাতে খাবারের পর অবশিষ্ট বেচে যাওয়া ভাত সাধারনভাবে রেখে দিলে নষ্ট হয়ে যায়। আর এ নষ্টের হাত থেকে ভাতকে ভাল রাখতে পানি দিযে ভিজিয়ে রাখা হয় ভাত। এ সময় ভাত পানির ভিতরে অবস্থান করে যাতে অক্সিজেন চলাচল করতে পারেনা। এতে করে ভাত দীর্ঘসময় নষ্ট নয়না। তবে এভাবে ১২ ঘন্টা বা এর অধিক সময় ভিজিয়ে রাখলে ভাত টক হয়ে যেতে পারে যার ফলে ভাতের পুষ্টি গুন নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

পান্তা ভাত খাওয়ার পদ্ধতি

আগের দিনের ভাত পানিতে ভিজিয়ে রেখে পান্তা ভাত তৈরি করা হয়। পান্তাভাত তৈরি হয়ে গেলে তাতে লবণ মিশিয়ে খাওয়া হয়। কেউ কেউ শুধু লবন দিয়ে খেতে ভালবাসলেও এর সঙ্গে কাঁচা পেয়াজ, মরিচ, মাছ ভাজা (ইলিশ মাছ হলে স্বাদটি আরো অনেক ভাল লাগে) ডালের বড়া, ডিম ভাজা এমন মানুষের কাছে জানা যায় তাদের নাকি পাকা কলা ও আম দিয়েও খুব মজার সহিত পান্তা ভাত খেতে থাকে।

কীভাবে পান্তা ভাতের পুষ্টিগুন বাড়ানো যায়

পান্তা ভাত এমনিতেই একটি দারুন পুষ্টিকর খাবার যা সাধারন ভাতের তুলনায় অনেক বেশি। এর সঙ্গে আমরা যদি আরো কিছু পুষ্টিকর খাবার মিশিয়ে খেতে পারি তাহলে এর পুষ্টি উপাদান বৃদ্ধি পায় খুব দ্রুত। এর সঙ্গে সবজি, বাদাম, ডাল, প্রোটিন সমৃদ্ধ মুরগির মাংস দিয়ে খেলে তা আরও সুস্বাদু ও পুষ্টিকর একটি খাবারে পরিনত হবে।

পান্তা ভাতের পুষ্টিগুন

গবেষনায় দেখা গেছে পান্তাভাত মাইক্রোফ্লোরা সমৃদ্ধ এক ধরনের বিশেষ খাবার, যা একটি প্রিবায়োটিক হিসাবে কাজ করে থাকে। এটি অন্ত্রের সংক্রমণ রোধক, শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, ভাল হজমশক্তি হিসাবে কাজ করে, ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি সহ চুলের জন্য খুব ভাল কাজ করে। পান্তা ভাত একটি ইলেক্ট্রোলাইট হিসাবে কাজ করে তাই এটি ক্লান্তি, দুর্বলতা এবং ডিহাইড্রেশন নিরাময়ক হিসাবে খুব ভাল কাজ করে। পান্তাভাতে বিভিন্ন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পদার্থ, মেটাবোলাইট যেমন ফেনোলিক্স, ফ্লাভন, ভিটামিন-ই, ফাইটোস্টেরল, লিনোলিক অ্যাসিড, অ্যান্থোসায়ানিন সহ বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ। এটি শরীর বান্ধব ব্যাকটেরিয়া কোলেস্টেরল কমাতে, পেরিস্টালসিস উন্নত করতে এবং ডায়রিয়া প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এছাড়াও এক গবেষনায় দেখা গেছে পান্তা ভাতে নানা ধরনের মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা পুষ্টিকর খনিজ পদার্থ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, জিংক, ফসফরাস, ভিটামিন-বি। এক গবেষনায় দেখা গেছে ১০০ মিলিগ্রাম সাধারণ ভাতে আয়রনের পরিমাণ থাকে ৩.৫ মিলিগ্রাম। কিন্তু ভাত ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখার পর তৈরিকৃত পান্তা ভাতে এর পরিমাণ বেড়ে বৃদ্ধি পায় ৭৩.৯ মিলিগ্রাম। একইভাবে পান্তা ভাতে ক্যালসিয়ামের পরিমানও অনেকগুন বেড়ে যায়। ১০০ মিলিগ্রাম সাধারণ ভাতে যেখানে ক্যালসিয়ামের উপস্থিতি থাকে ২১ মিলিগ্রাম সেইক্ষেত্রে পান্তা ভাতে এর পরিমান বেড়ে দাড়ায় ৮৫০ মিলিগ্রামে।

পান্তা ভাতের উপকারিতা

এখন আসুন পান্তা ভাতের বিভিন্ন উপকারিতা সমূহ জেনে নেওয়া যাক

ক্লান্তি দুর করে

ভিটামিন বি ১২ রয়েছে পান্তা ভাতে ফলে পান্তা ভাত যার ফলে এটি শরীরের ক্লান্তি দুর করে।

অ্যাসিডিটি থেকে মুক্তি

পান্তা ভাত অ্যাসিডিটি থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করে। পান্তা ভাত খাওয়ার ফলে পেট ঢান্ডা থাকে যার ফলে অ্যাসিডিটি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক আংশে কম থাকে। এছাড়াও এটি আলসার রোগীদেরও সুফল বনে আনে।

স্তনদানকারী মাদের জন্য

পান্তাভাত স্তনদানকারী মায়েদের জন্য খুব উপকারী একটি খাবার। পান্তাভাতে ফারমেন্টেশনের ফলে ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি করে। যার ফলে স্তন্যপান করানো মায়েদেরদুদ্ধ উত্তপাদনে সাহায্য করে পান্তা ভাত।

কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দুর করে পান্তাভাত

পান্তা ভাত ন্যাচারাল ল্যাক্সেটিভ হিসেবে কাজ করে। যার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সহায়তা করে পান্তা ভাত।

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন করে পান্তা ভাত

কেউ যদি পান্তা ভাত খেয়ে থাকেন তাহলে এটি খুব সুন্দর কাজ করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন করতে। সাধারণ ভাতের তুলনায় পান্তাভাতে সোডিয়ামের পরিমান কম থাকে। অপরদিকে পটাশিয়ামের পরিমান বেশি। বিধায় রক্তচাপ থাকা রোগীরা নিঃসন্দেহে পান্তা ভাত খেতে পারেন।
 
আরো পড়ুন: উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনের পদ্ধতি

রিহাইড্রেশন

পান্তাভাত রিহাইড্রেটিং খাবার হিসাবে ব্যপক পরিচিত। তাই গরমকালে পান্তা ভাত রিহাইড্রেশন খাবার হিসাবে এর জুড়ি মেরা ভার।

ওজন কমাতে সহায়তা করে

পান্তাভাত ওজন কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফারমেন্টেশনের কারণে পান্তায় কার্বোহাইড্রেট এবং ফ্যাটের পরিমাণ অনেকটাই কমে যায়। তাই অনেক ক্ষেত্রে ওয়েট লসে কার্যকরী হয়। তবে অবশ্যই সেটা সীমিত পরিমাণে খেতে হবে।

ত্বকের উজ্জলতা বৃদ্ধি করে

পান্তা ভাতকে বিউটি সেক্রেট অফ এশিয়া বলেও অবিহিত করা হয়। কারন এটি কোলাজেন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।এটি ত্বকের ইলাস্টিসিটি বৃদ্ধি করে। যার কারনে ত্বক মশৃণ, টনটনে ও ত্বকের উজ্জলতা বৃদ্ধি পায়।

মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টে ভরপুর

পান্তাভাত মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ভরপুর একটি খাবার। উদাহরণস্বরুপ ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রনের মতো উপাদান প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পায়। ১০০ গ্রাম সাধারন ভাতে ৩.৪ মিলি আয়রন থাকে অন্যদিকে পান্তা ভাতে সেটার পরিমান দাঁড়ায় প্রায় ২১ গুন যা ৭৩.৯১ মিলি।

কোলেস্টেরল হ্রাস

পান্তায় কিছু রেজিস্ট্যান্স স্টার্চ তৈরি হয়। এটি অনেক ক্ষেত্রে সিরাম কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। তাই পান্তা ভাত খাওয়া অনেক নিরাপদ।

উপকারি ব্যাকটেরিয়া

প্রোবায়োটিক্সে ভরপুর পান্তা ভাত। এটি হজমশক্তি রক্ষায সাহায্য করে। সেই সঙ্গে পান্তা সারাদিন কাজ করার জন্য শক্তি যোগাতে সাহায্য করে।

ভাল ঘুম হয়

পান্তা ভাত খেলে খুব ভাল ভুম হয়। পান্ত ভাত খাওয়ার ফলে শরীর ঠান্ডা থাকে পেট ঠান্ডা থাকে যার বলে খুব ভাল একটি ঘুম হয় পান্তা ভাত খাওয়ার ফলে।

রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধি করে

পান্তা ভাত দেহের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে আয়রন। যা পান্তা ভাতে প্রচুর পরিমান পাওয়া যায়।

হাড় শক্ত করে

শরীরের হাড় শক্ত করে ক্যালশিয়াম এবং শরীরে নিঃসৃত এনজাইমকে সক্রিয় করতে সাহায্য করে ম্যাগনেসিয়াম যা পান্তা ভাতের মধ্যে পাওয়া যায়।

ক্যান্সার প্রতিরোধক

পান্তা ভাতে রয়েছে আইসোরহ্যামনেটিভ সেভেন গ্লুকোসাইড ফ্লাভোনয়েডের মতো মেটাবলাইটস যা ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

ভাল ব্যাকটেরিয়ার যোগান দেয়

এক গবেষনায় দেখা গেছে পান্তা ভাতে ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া রয়েছে যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। যা সাধারণত দই এর মধ্যে এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়।

উপসংহার

পান্তা ভাত গ্রাম বাংলার একটি খুব সাধারণ একটি খাবার। কিন্তু পান্তা ভাতের মধ্যে যে পরিমান পুষ্টি উপাদান রয়েছে যা আমাদের পূর্বে হয়তো জানা ছিলোনা। শহরে জীবনে এর তেমন গুরুত্ব বা প্রভাব নাই বললেই চলে। কিন্তু আমাদের সুস্থ্য ভাবে প্রাকৃতিক নিয়মে বেচে থাকলে হলে এই সকল খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া জরুরী।

শেষ কথাঃ পরিশেষে যাই হোক পান্তা ভাত সাধারণত দক্ষিন এশিয়ার ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান সহ মিয়ানমার ভারতের গুজরাট, তামিলনাড়ু সহ অন্যান্য স্থানেও পাওয়া যায়। কিন্তু একেক স্থানে একেক নামে পরিচিত এই খাবারটি। প্রিয় পাঠক আশা করি এই পোস্টরি মাধ্যমে আপনি উপকৃত হবেন। এরকম আরো গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট পেতে আমাদের পেজে ঘুরে আসতে পারেন। ধন্যবাদ

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আপডেট ব্লগ২৪ এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন; প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়;

comment url